বকুল ফুলের মালা

বকুল ফুলের মালা
॥ মনজুর সাদেক ॥

গুলশান পার্ক থেকে বেরুচ্ছি । গেটের মুখে এক অশীতিপর নারী বকুল ফুলের মালা বিক্রি করছেন । দু’টি মালা একশ টাকা । আমি কোন তর্ক ছাড়াই তাঁকে একশ টাকা দিয়ে দিই । পরদিন আবার পার্কে হাঁটছি । পার্কের ভেতরে বেশ কয়েকটা উপবৃত্তাকার পথ । একটা বড় বৃত্ত, একটা ছোট বৃত্ত । আজকে ছোট বৃত্ত দিয়ে হাঁটছি । এখান থেকে পার্কের দিঘীতে আমার ছেলের সাঁতরানো সহজে দেখা যায় । এত ভোরে কেউ দিঘীতে নামে নাই । আজ আমার ছেলের তিন কিলো সাঁতার কাটার টার্গেট । এজন্য আমরা একটু ভোরে চলে এসেছি । মিরপুর থেকে গুলশান-কালশী ফ্লাইওভার কিংবা ক্যান্টনমেনন্টের ভেতর দিয়ে এখন অনেক সহজ । 
হঠাৎ দেখি, পার্কের রাস্তায় বকুল ফুল ছড়িয়ে আছে । উপর দিকে সাদা, নীচের দিকে সোনালী রংয়ের ছোট ফুল । ‘জলের গান’ ব্যান্ডের একটা গান আছে । বকুল ফুল, বকুল ফুল- সোনা দিয়া দাঁত কেনো বাঁধাইলি । বকুল ফুলের লাজ নাই, রাইতে বকুল ফুটেরে- রাইতে বকূল ফুটে । আমি গানটার কথা ভাবতে ভাবতে একটা বকুল ফুল হাতে নেই । 
গেটের কাছে মালা বিক্রেতা খালার কথা মনে পড়ে । খালা তাহলে- এই ফুল দিয়েই মালা গাঁথেন । আমি ছোট বৃত্ত থেকে বড় বৃত্তে হাঁটতে থাকি । আবার ছোট বৃত্তে আসি । বকুল ফুল গাছের নীচে খালার সাথে দেখা হয়ে যায় । যা ভেবেছিলাম, তাই । খালা মালা গাঁথবেন বলে ফুল কুড়াচ্ছেন । খালাকে প্রশ্ন করি- এই ফুল দিয়ে মালা গেঁথে বিক্রির আইডিয়া কে দিল ?

খালা তাঁর গল্পের ঝাপি খুলেন । শখ করে মেয়ের বিয়ে  দিয়েছিলেন ঢাকায় । জামাই দুটো নাতনী রেখে, মেয়েটাকে ছেড়ে চলে গেছে । শরীয়তপুরে নিজে ছেলের কাছে থাকতেন । মেয়েটা বিপদে পড়ায় মেয়ের কাছে এসেছিলেন । মেয়ে এই পার্কে ক্লিনারের কাজ করে ।  স্থায়ী কোন চাকরি নয়- একটা কোম্পানির টেম্পরারি চাকরি । এই কোম্পানি পার্কের দেখাশোনা করে । কালাচাঁনপুরের কাছে একটা বস্তিতে থাকেন । মেয়ের আয় ব্যয়ের হিসেব না মেলায় দুই নাতনীকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার কথা ভাবছিলেন । একদিন পার্কে এসে, বকুল ফুল দেখে মালা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন । সকাল বেলার দু’ঘন্টা পরিশ্রম - তিন চারশ টাকা পাওয়া যায় । বাকি সময় নাতনীদের দেখাশুনা করেন । নাতনীরা স্কুলে যায় । তাঁদের জন্য রান্না বান্না ও করেন । 
আমি খালার ‘সারভাইভাল স্টোরি’ শুনে ভাবতে থাকি । দরিদ্র এবং নিম্নবিত্তদের ‘সারভাইবাল স্টোরি’ ইনোভেশনে পুর্ণ । তাঁরা ‘সাপ্লাই চেইন’ এবং ‘ভ্যালু এডিশন’ সবচেয়ে ভাল বোঝেন । দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই কি মানুষের বুদ্ধি খোলে ? সবার ক্ষেত্রে নিশ্চয় খোলেনা । এদের  কেউ কেউ শত প্রতিকুলতায় স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখেন ।  যারা ঝরে যান, হতদরিদ্রে পরিণত হন । 
এ্ই ঢাকা শহরে দরিদ্র এবং নিম্নবিত্তদের প্রত্যেকের ‘বলার মত একটি গল্প’ আছে । প্রতিদিন অসংখ্য গল্প জমা হচ্ছে । কবি শহীদ কাদরি বলেছিলেন, বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্ক । সারা বিশ্বের জনস্রোত নিউইয়র্কে জমা হয় । এখানেই সবচেয়ে বেশি ‘সারভাইবাল স্টোরি’র জন্ম হয় । লিগ্যালদের জন্য আমেরিকায় ‘সোশ্যাল সিকিউরিটি’ আছে । ইল্লিগ্যালদের জন্য ‘দ্য এমেরিকান ড্রিম’ । 
ঢাকা শহরে একজন আল্লাহ আছেন । 
তিনিই- এত অসহায় মানুষদের সবাইকে দেখে রাখেন । যারা তাঁকে ডাকেন, তাঁদেরকে দেখেন । যারা তাঁকে ডাকেনা, তাঁদেরকে ও দেখেন । 
তবে, তাঁর দেয়া মস্তিষ্ক ব্যবহার করলে তিনি খুব খুশি হন । ভাবেন, তাঁর দেয়া ‘উপহার’ এরা অযত্নে ফেলে রাখেনি-কদর করেছে ।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক, আমার গ্রাম-আমার শহর : পাইলট গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প, এলজিইডি।
আপনার মন্তব্য দিন

প্রকাশিত মন্তব্য

কলাম

পরিচালনা সম্পাদক: মোহাম্মদ মুজিবুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক: মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম ও সহ সম্পাদক: ড. মোঃ আশরাফুল ইসলাম (সজীব)

© 2024 Dainik Coxsbazar, All Rights Reserved.